Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

বরিশাল অঞ্চলের খই-মুড়ির ধান

যে যুগে বেকারি বা কনফেকশনারি ও ফাস্ট ফুড ছিল না তখন চিড়া, খই, মুড়িই ছিল গ্রাম বাংলার অন্যতম জল খাবার এবং অতিথি আপ্যায়নের সামগ্রী, লৌকিকতার প্রধান উপকরণ। এখন যেমন শরবত, স্কোয়াশ, কোকা কোলা, ফান্টা ইত্যাদি হলো আপ্যায়নের পানীয়- সে যুগে ছিল ডাবের পানি। এখনো গ্রাম বাঙলায় আপ্যায়নের এই রীতি বহমান। তবে আধুনিকতার মিশেলে সেই ঐতিহ্য মূলধারাটি অনেক জায়গাতেই খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এর কারণ বহুবিধ। বাঙালির খাদ্যাভ্যাস ও রুচি পরিবর্তনের পাশাপাশি বর্তমান ব্যস্ত ও কর্মচঞ্চল জীবনধারায় বাড়ির মেয়েদের খই মুড়ি ভাজার জন্য আলাদা সময় কোথায়? তাছাড়া এসব করতেও আলাদা একটা দক্ষতা ও কৌশলের প্রয়োজন হয় যা বাঙালি পরিবারগুলোতে বংশপরম্পরায় রপ্ত হয়। দাদি দিদিমা পারলে নাতনিরাও পারে, শাশুড়ি জানলে পুতের বউকে শিখিয়ে যায়। কিন্তু তারাই যদি না জানেন তাহলে এই জানা শেখাটা আসবে কোথা থেকে? এর জন্য তো আলাদা কোনো পাঠশালা বা বই নেই। এটা একান্তই আমাদের লৌকিক ক্রিয়া ও মৌখিক লোকজ ধারা। এ ছাড়া খই, মুড়ি, মুড়কি, চিড়া তো আর সব ধানের চালে হয় না। তার জন্য বিশেষ বিশেষ জাতের ধান লাগে। একটা লোকগানের মাধ্যমে আমরা সে পরিচয় পাই-
কচ্-কচা-কচকচ্-কচা-কচ্ ধান কাটিরে
(ও ভাই) ঝিঙ্গাশাইলের হুড়–ম ভালা
বাঁশফুলেরই ভাত
লাহি ধানের খইরে
দইয়ে তেলেসমাত্ ।...
কস্তুরগন্ধীর চাউলের আলা
সেই চাউলেরই পিঠা ভালা
সেই পিঠায় সাজিয়ে থালা
দাও কুটুমের হাতে রে।
বলা বাহুল্য ওসব জাতের সবই দেশি বা স্থানীয় জাতের ধান। এগুলো নিম্নফলা হওয়ায় সেগুলোর আবাদ প্রায় উঠেই যাচ্ছে। হাজার দশেক ধান্যজাতের সম্ভার থেকে এখন ৯ হাজার ৯০০ জাতই হয়ত লুপ্ত হয়ে গেছে। বিন্নি ধানের খই আর শালি ধানের চিড়ার দেখা তাই বাজারে পাওয়া মুশকিল। সৌভাগ্য যে, প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক কারণে বরিশালের অনেক জমিতে আধুনিক জাতের ধান চাষ করা সম্ভব হয় না। সে কারণেই বরিশাল অঞ্চলে এখনো টিকে আছে আমাদের প্রাচীনকালের অনেক ধানের জাত। বলতে হয় অনেক কৃষক কিছুটা বাধ্য হয়েই সেসব জাতের ধান চাষ ধরে রেখেছে। স্থানীয় সেসব জাতের অধিকাংশ জাতের ধানই চাষ করা হয় আমন মৌসুমে। এসব স্থানীয় জাতের মধ্যে অনেক জাতের ধান থেকে খুব ভালো মানের খই ও মুড়ি তৈরি করা হয়, চিড়াও তৈরি করা যায়। এসব জাত তাই স্থানীয় কৃষকদের কাছে ‘খই-মুড়ির ধান’ হিসেবে পরিচিত। বরিশাল অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে স্থানীয় কৃষকদের সাথে কথা বলে খই-মুড়ির ধানের যেসব জাতের নাম পাওয়া গেছে তা তালিকায় উল্লেখ করা হলো। এসব জাতের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা আধুনিক জাত উন্নয়নে জার্মপ্লাজম হিসেবে প্রজননের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যেতে পারে। হারিয়ে যাওয়ার আগেই তাই এসব জাত সংগ্রহ ও সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া দরকার।


চিড়া কুটতে ঢেঁকি লাগে, মুড়ি ভাজতে ঝাঝর। বাঙলা থেকে এসব উপকরণও এখন বিলুপ্তপ্রায়। আর এক আগ্রাসন হলো চিড়া মুড়ির কল। আধুনিকতার স্পর্শে এখন মুড়ি ভাজা হচ্ছে যান্ত্রিক কলে, চিড়াও বানানো হচ্ছে মেশিনে। অনেক পরিমাণে চিড়া মুড়ি দ্রুত করা যায় দেখে এসব কলের চাহিদা বর্তমানে যথেষ্ট বেড়েছে। তাছাড়া মেশিন বলে কথা। এখন ওসব মেশিনের ধাক্কায় পড়ে যান্ত্রিক কৌশলে এখন আধুনিক ধানের জাত বিআর২৮ ধান থেকেই ভালো মুড়ি তৈরি হচ্ছে, এখন আর মুড়ি বা হুড়–ম ভাজতে ঝিঙ্গাশাইল ধানের দরকার হয় না। কিন্তু মুরুব্বিরাই ভালো বলতে পারবেন, ছোটবেলায় তারা যে মুড়ি চিড়া খেয়েছেন, তার স্বাদ কি এখনকার প্যাকেট মুড়ি চিড়ার মতো ছিল? হয়ত আমরাও দেশি মুরগির ডিমের স্বাদ ভুলে যেমন ফার্মের মুরগির ডিমের স্বাদে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, একদিন সে রকম কলের মুড়িতেও অভ্যস্ত হয়ে যাব। ভুলে যাব, আদিতে মুড়ি কি রকম ছিল! তবু ভাগ্য ভালো যে, কলে এখনো খই ভাজা ও মুড়কি তৈরি শুরু হয়নি।


ধান থেকে খই বানানো হয়। তাই বলে সব জাতের ধানে কিন্তু খই হবে না। দেশি ধানের অনেক জাত আছে যেগুলো থেকে খই হয়। এসব জাতকে বলা হয় খইয়া ধান। বিন্নি বা বিনি ধানের খই সবচেয়ে ভালো হয়। সেসব জাতের ধান ভালো করে রোদে শুকিয়ে শুকনো বালিতে চুলায় ভাজতে হয়। একটা মাটির খলা বা পাত্র কাঠের গরম করা হয়। অধিক গরম পাত্রের মধ্যে এক মুঠ ধান ছেড়ে দিলেই ফট ফট করে খই ফুটতে থাকে। এজন্য যেসব লোক বেশি কথা বলে তাদের সে স্বাভাবিকে অনেক সময় এর সাথে তুলনা করে বলা হয়, মুখে যেন কথার খই ফুটছে। খই ফোটার সময় শলার ঝাড়– দিয়ে নাড়তে হয়। খই ফুটলেও ফোটা খইয়ের সাথে অনেক ধানের তুষ বা খোসা লেগে থাকে। ওগুলো হাতে বেছে ছাড়াতে হয়। পরে সেসব খই খাওয়ার উপযুক্ত হয়। একে বলে ‘সাদা খই’। সাদা খই দই দিয়ে খেতে খুব মজা। আমাদের কর্ন ফ্লেক্স নেই, কিন্তু খই আছে। দুধে ডুবিয়ে খই ভিজিয়ে খেতে কর্ন ফ্লেক্সের চেয়েও সুস্বাদু লাগে। খইয়ে গুড় মাখিয়ে বানানো হয় ‘মুড়কি’। মুড়কি ও সাদা খই একসাথে মিশিয়ে খেতেও ভালো লাগে। এ ছাড়া খই থেকে খই ছাতু ও খইয়ের মোয়াও বানানো হয়।


ধান থেকে হাতে দেশি পদ্ধতিতে মুড়ি ভাজা এ জটিল প্রক্রিয়া। বিশেষ অভিজ্ঞতা ছাড়া এ কাজ করা যায় না। মুড়ির ধান মাড়াইয়ের পর তা পরিষ্কার করে রোদে শুকানো হয়। রোদে ধানের রস টানার পর তা ভাপ দিয়ে হালকা সেদ্ধ করা হয়। এরপর তা ৩-৫ দিন পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। এরপর আবার ভাপে সেদ্ধ করা হয়। একটা বড় হাঁড়িতে পানি ফোটে। এর ওপরে ছিদ্রযুক্ত একটি পাত্রে ধান রেখে একটা ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। এতে পানির ভাপে ধান সেদ্ধ হয়। এ সময় ধানের মুখ ফাটলে তা তোলা বা নামানো হয়। সেদ্ধ ধান একটু আঠালো হলে তাতে মুড়ি ভালো হয়। সেদ্ধ করার সময় ধান যদি বেশি সেদ্ধ হয়ে ভাতের মতো গলে যায় তবে তাতে আর মুড়ি হবে না। এরপর সেদ্ধ করা ধান আবার রোদে শুকানো হয়। যখন চাল শক্ত হয়ে যায় তখন তোলা হয়। এরপর কলে বা ঢেঁকিতে ভানা হয়। তুষ-কুঁড়া পরিষ্কার করে মুড়ির চাল বানানো হয়। মুড়ি ভাজার আগে একটি মাটির পাতিলে চালে লবণ পানি ছিটিয়ে মাখা হয়। লবণ পানি এমনভাবে মাখানো হয় যাতে সবগুলো চালে তা মাখে। মাটির পাত্রে তাপ দিয়ে এসব চাল একটা কাঠি দিয়ে অনবরত নাড়তে হয়। তাপে চালগুলো যখন লাল হয়ে ওঠে তখন পাশে আর একটি চুলায় রাখা পাত্রের গরম বালির মধ্যে ঢেলে গইর দিলে মুড়ি হয়ে যায়। পাশে ছিদ্রযুক্ত আর একটি পাত্র বা ঝাঝরে ঢেলে পিছা বা শলা দিয়ে নেড়ে মুড়ি থেকে বালিকে আলাদা করা হয়। সেসব বালি আবার চুলায় বসানো হয় ও তাতে একইভাবে মুড়ি ভাজা চলতে থাকে। সাধারণত এক কেজি চালে এক কেজি মুড়ি হয়। স্থানীয় বাজারে এক কেজি চালের দাম প্রায় ৪০ টাকা, এক কেজি মুড়ি বিক্রি হয় ৭০-৮০টাকায়। মুড়ি গুড়ে পাক দিয়ে বানানো হয় মুড়ির মোয়া। ঝাল মুড়ি অনেকেরই একটি প্রিয় খাবার।


খই মুড়ির ধান
সব জাতের ধানে খই মুড়ি হয় না। খই মুড়ির জন্য বিশেষ জাতের ধান লাগে। উপকূলীয় অঞ্চল সেসব আদি জাতের ধানের এক অপূর্ব ভাণ্ডার। নানা কারণে বরিশালের খ্যাতি রয়েছে। এর মধ্যে বরিশালের মোটা মুড়িও খ্যাতির একটি কারণ। মোটা দানার চাল থেকে সুস্বাদু এই মুড়ি তৈরি হয় যা এ দেশের অন্য অঞ্চলে দেখা যায় না। এ অঞ্চলে শুধু নয়, দেশের অন্যান্য স্থানেও এ মুড়ির কদর রয়েছে। বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা, ভোলা, ঝালকাঠি প্রভৃতি জেলায় যত জাতের ও যে পরিমাণে খই মুড়ির ধান উৎপন্ন হয় তা অন্যান্য জেলায় দেখা যায় না। ঝালকাঠি জেলা মুড়ি শিল্পের জন্য বিখ্যাত। বহু লোক মুড়ি ভাজা ও ব্যবসাকে জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছে। অনুসন্ধান করলে হয়তো এ অঞ্চলে শতাধিক জাতের খই-মুড়ির ধান পাওয়া যাবে। তবে দ্রুত এসব জাত বিলুপ্ত হতে চলেছে। আগে যেসব জমিতে এসব জাতের ধান ছাড়া অন্য জাতের ধান আবাদের কোনো সুযোগ ছিল না। এখন খই মুড়ির ধান চাষের জমিতে উচ্চফলনশীল আধুনিক জাত আবাদ করা সম্ভব হচ্ছে। ইতোমধ্যেই ব্রিধান ৪৭, ব্রিধান ৫২, ব্রিধান ৫৭, ব্রিধান ৬২ ইত্যাদি জাতের ধান খই মুড়ির ধানের জায়গায় জায়গা করে নিতে শুরু করেছে। সরেজমিনে এসব জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ঘুরে খই মুড়ির যেসব জাতের নাম পাওয়া গেছে তা তালিকা ১-এ দেয়া হলো। এসব জাতের মধ্যে মোতা মোটা জাতের মুড়ি সবচেয়ে ভালো হয় এবং এ জাতটি এ অঞ্চলের একটি জনপ্রিয় জাত। বৌয়ারি জাতের ধানের খই ভালো হয়। তবে বেশি ভালো খই হয় খৈয়া ধানের। খৈয়া ধানের রং কালো, শুঙ লম্বা, জীবনকাল ১২০ থেকে ১৩০ দিন, খই হালকা সুগন্ধযুক্ত, মিষ্টি, বড় ও খই কামরাঙার মতো খাঁজবিশিষ্ট। এ জাতের ধান থেকে তৈরি করা খই সাধারণত প্রতি কেজি ১০০ টাকা দরে বাজারে বিক্রি হয়। ধানের দর মণপ্রতি ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা।


খই মুড়ির ধানের চাষাবাদ
খই মুড়ির ধান চাষ করা হয় আমন মৌসুমে। রোপা পদ্ধতিতে এসব জাতের ধান চাষ করা হয়। মাঠের ধানের জমি ছাড়া চরেও এসব ধান চাষ করা হয়। ধানের চারা তৈরি করে প্রায় দুই মাস বয়সী কয়েকটা চারা গোছ ধরে চাষ করা কাদাময় জমিতে রোপণ করা হয়। শুধু ইউরিয়া ছাড়া অন্য কোনো সার দেয়া হয় না। আগাছা সাফ করতে হয়। এসব ধানে তেমন কোনো রোগ-পোকার উপদ্রব হয় না। ১৫০ থেকে ১৬০ দিন এসব ধানের জীবনকাল। শ্রাবণে ধান লাগিয়ে অগ্রহায়ণ মাসে ধান কাটা হয়।

মৃত্যুঞ্জয় রায়

উপপরিচালক (এলআর), ডিএই, খামারবাড়ি, ঢাকা। ঔষধি গাছ (১ম ও ২য় খণ্ড), ডাল, তেল ও মসলা ফসল চাষ, ফলের রোগ, ধানের রোগ, শাকসবজির পোকামাকড় ইত্যাদি বইয়ের লেখক। মোবাইল : ০১৭১৮২০৯১০৭ মোবাইল :  kbdmrityun@yahoo.com

 


COVID19 Movement Pass Online Police Clearance BD Police Help line Expatriate Cell Opinion or Complaint NIS Bangladesh Police Hot Line Number Right to Information PIMS Police Cyber Support for Women BPWN Annual Training Workshop Achievement & Success PHQ Invitation Card
Press Release Recruitment Information Procurement / Tender Notice Legal Instrument Innovation Corner Detective Magazine Bangladesh Football Club Diabetes-Covid19 Exam Results Accident Info Important Forms

Apps

icon icon icon icon icon icon